তিমির বিদারী পাঠাগার
মূলধারা '৭১
লেখক: মঈদুল হাসান
দাতা: ইয়াসির আরাফাত নাদিম
মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে একটি অমূল্য সংযোজন। লেখক মঈদুল হাসান একাত্তর সালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক,সামরিক ও কূটনৈতিক সকল মূল উপাদানকেই একত্রিত করে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। এসব উপাদানের সংঘাত ও সংমিশ্রণে কিভাবে সফল রণনীতির উদ্ভব ঘটেছিল সেই ইতিবৃত্তই তিনি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন এই বইটিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত গ্রন্থটির আলোচ্য ঘটনাবলীর সময়কাল, ২৫ মার্চের কালরাতে শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদের সীমান্ত অতিক্রম, সরকার গঠন, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্ধের মধ্যেও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সে সরকারের এগিয়ে যাওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রকৃত অবস্থা,শপথ গ্রহণ, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ,সাড়া, বহির্বিশ্বে সাহায্যের আবেদন, ভারত-পাকিস্তান টানাপড়েন, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক, পাক-যুক্তরাষ্ট্র সুসম্পর্ক; এসবের মধ্য দিয়ে বাঙালির প্রতিরোধ, সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসা, সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ, গেরিলা আক্রমণ, শক্তিবৃদ্ধি, ভারতের সহায়তা, মিত্রবাহিনীর সাথে যৌথবাহিনী গঠন,বিজয় অর্জন এসবের প্রত্যেকটি ঘটনাপ্রবাহই আলোচনা করে গেছেন লেখক তাঁর নিজস্ব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে; যাতে উঠে এসেছে অনেক অজানা অধ্যায়। এছাড়া অনেক ঘটনা ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন, যেগুলির অনেক কিছুই আজও অপ্রকাশিত, অথচ এসব ছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধের গতি-প্রকৃতির কোন সুসংগত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। এ জাতীয় বিবরণ সম্ভবত কেবল মঈদুল হাসানের পক্ষেই লেখা সম্ভব। কারণ, প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নীতি-প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং তাঁর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের উচ্চতর নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ব্যাপারে তিনি (লেখক) ছিলেন আস্থাভাজন ব্যক্তি। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ হতে ১৯৭২ এর জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবলীর বিবরণ লেখক তুলে ধরেছেন ২২টি অধ্যায়ে। ৯০ পৃষ্ঠার পরিশিষ্ট অংশে তুলে ধরেছের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র। কাজেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানতে বইটির গুরুত্ব অসামান্য। [ রিভিউ করেছেন: আল শাহরিয়ার হৃদয় ] যেকোনো যুদ্ধের ইতিহাসই নানা রকম জটিল উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠার কথা, ওঠেও। বিশেষ করে, এ যুগের যুদ্ধগুলো শুধু অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক প্রভাব ও পরিপ্রেক্ষিতও থাকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তেমনই একটি বিষয়। মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে মঈদুল হাসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এমন একটি অধ্যায়ের—‘মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও মূল ঘটনাধারা’— প্রকৃত স্বরূপ তুলে এনেছেন, যেটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় প্রায় উপেক্ষিতই থাকে, আর এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে। যুদ্ধের সময় এই লেখক অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং সংগ্রামের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। সংগত কারণেই সেসবের একটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ এ গ্রন্থে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তান যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে, ২৫ মার্চের অনেক আগেই শেখ মুজিব সেটি অনুমান ও আশঙ্কা করেছিলেন এবং সে রকম কিছু ঘটলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সহায়তা পাওয়া যেতে পারে, সেটি জানার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে ৫ বা ৬ মার্চ ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠিয়েছিলেন। সেনগুপ্ত এর উত্তর সন্ধানে দিল্লিতে যান এবং ফিরে এসে তাজউদ্দীনকে ভাসাভাসাভাবে জানান, ‘পাকিস্তানি আঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশন সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন; তবু “আঘাত যদি নিতান্তই আসে” তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্য “সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা” প্রদান করবে।’ ২৪ মার্চ সেনগুপ্তের সঙ্গে তাজউদ্দীনের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হতে পারেনি। ফলে ২৫ মার্চের হামলার পর ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, এই অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই তাজউদ্দীন তাঁর তরুণ সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে সীমান্তে পৌঁছান। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ এসে পৌঁছেনি। ৩ এপ্রিল তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে জানান যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ২৬ বা ২৭ মার্চেই একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিনি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এই সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধও জানান। কিন্তু তখন পর্যন্ত সরকার গঠন তো দূরের কথা, সহকর্মীরা বেঁচে আছেন কি না, সেটাও তাজউদ্দীনের জানা ছিল না! উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় ১০ এপ্রিল, শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। যদিও এর আগেই ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতার ভাষণ দেন। তিনি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন, এর পেছনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিরোধযুদ্ধে সহায়তা চাওয়া আর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সহায়তা চাওয়া যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার এবং ভিন্ন মাত্রাযুক্ত, সেটা তাজউদ্দীন আহমদ যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সাক্ষাতের শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধী জানতে চেয়েছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই কোনো সরকার গঠন করেছে কি না!’ ইতিবাচক উত্তর পেয়ে তিনি ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন।’ তাজউদ্দীন আহমদের এই দূরদর্শিতা তাঁর ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের’ নয় মাস ধরেই কার্যকর ছিল। আরেকটি উদাহরণ দিলে সেটি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও এটিকে তিনি স্রেফ ‘দাবি’ হিসেবেই জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, কোনো চাপ বা তদবির করে একে ত্বরান্বিত করতে চাননি। কারণ, একদিকে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের বাস্তবসম্মত কিছু অসুবিধা ছিল; সেটি যেমন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় স্বীকৃতি পেলে পাকিস্তান একে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ বলে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেত এবং একে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার চেষ্টা করত, যা পরিশেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অঙ্কুরেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত—সেটিও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রজ্ঞার কারণে বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারলেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই সেটি পারেননি। ফলে সরকার গঠনের পর থেকেই তাজউদ্দীন আহমদকে নানা রকম উপদলীয় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়। সেসবের বিস্তারিত বিবরণও আছে এই গ্রন্থে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রথম থেকেই নানাভাবে সহায়তা করেছিল এবং এসব সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এত দ্রুত জয়লাভ করা কঠিন হতো—এ কথা অনস্বীকার্য, কিন্তু এ-ও মনে রাখা দরকার যে ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারই পাকিস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন, নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন, ওদের মনোবলকে নিয়ে এসেছিলেন শূন্যের কোঠায়। এটা না করতে পারলে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাত্র ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানিদের পরাজিত করা ভারতীয়দের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য, ভারতীয় স্থলবাহিনী বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক অভিযানে পাকিস্তানিরা যখন পলায়নপর এবং মানসিকভাবে পরাজিত, তখন ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ তাদের এই পরাজয়কে কেবল ত্বরান্বিত ও অনিবার্য করে তুলেছিল। মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে লেখক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এসব দুঃসাহসিক অভিযান ও এর ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ দেননি, তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ফলে এই গ্রন্থটিও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়। তবে একটি অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন করে তিনি আমাদেরকে চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। [ রিভিউ করেছেন: জাহান ই নূর ] বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে এটি একটি অবশ্য পাঠ্য বই। এর আলোচিত সময় ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারীতে শেখ মুজিবরের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকাল পর্যন্ত। বিষয়বস্তু হলো মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও মূল ঘটনাধারা। লেখক এ সময়টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের যে সব নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং সংগ্রামের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যে দিকগুলো সম্পর্কে অবহতি ছিলেন, তাই বর্ণনা করেছেন। [ রিভিউ করেছেন: মোশতাক আহম্মেদ ]